বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠী একটি অলীক কল্পনা উক্তিটির ব্যাখ্যা
ভূমিকা: পৃথিবীতে মানুষের বসবাস বহু হাজার বছর ধরে। এই দীর্ঘ ইতিহাসে মানুষের বংশানুক্রমিক বিবর্তন, ভৌগোলিক বিস্তার, পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ফলে মানব সমাজে গড়ে উঠেছে নানা রকম নৃগোষ্ঠী। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিচার করলে দেখা যায়, মানবজাতি মূলত এক উৎস থেকে এসেছে। তাই “বিশুদ্ধ” বা “খাঁটি” নৃগোষ্ঠীর ধারণাটি বাস্তব নয়, বরং এটি কল্পনার সৃষ্টি। এই প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে, “বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠী একটি অলীক কল্পনা।”
বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠীর ধারণা:
নৃগোষ্ঠী বলতে এমন একটি মানবগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়, যারা বংশগত বৈশিষ্ট্য, শারীরিক গঠন, চেহারার বৈচিত্র্য, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও ইতিহাসের ভিত্তিতে নিজেদের অন্যদের থেকে আলাদা করে। “বিশুদ্ধ” নৃগোষ্ঠী বলতে বোঝানো হয় এমন এক জনগোষ্ঠী, যাদের রক্তের স্রোতে কোনো ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ঘটেনি।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর সব জাতি-গোষ্ঠীরই রক্তে কোনো না কোনোভাবে ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর রক্ত মিশেছে। তাই এ ধারণা যে মানবগোষ্ঠীগুলো শতভাগ খাঁটি বা বিশুদ্ধ, তা বৈজ্ঞানিক ও বাস্তব প্রমাণে অসমর্থনযোগ্য।
বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠী - অলীক কল্পনা কেন?
১. ইতিহাসজুড়ে নৃগোষ্ঠীগত মিশ্রণ:
মানব ইতিহাসে আদিকাল থেকেই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী একে অপরের সঙ্গে মিশেছে। যুদ্ধ, বাণিজ্য, অভিবাসন, দাসপ্রথা, উপনিবেশবাদ এসব ঘটনার ফলে এক নৃগোষ্ঠীর মানুষ অন্য গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে রক্তমিশ্রণ ঘটিয়েছে। ফলে, কোনো নৃগোষ্ঠী শতভাগ খাঁটি থাকার সুযোগই নেই।
২. প্রমাণিত গবেষণা:
বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী ডান এবং ডবঝেনস্কি তাঁদের ‘Heredity, Race and Society’ গ্রন্থে বলেন, “মানবজাতি সর্বদাই সংকর বা মিশ্র জাতি।” অপরদিকে নেস্টারুখ তাঁর ‘The Race of Mankind’ গ্রন্থে যুক্তরাষ্ট্র, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ও এশিয়ার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তমিশ্রণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ, মেক্সিকোর অধিকাংশ মানুষ ইউরোপীয় ও আদিবাসী ভারতীয়দের সংকর জাতি।
৩. আধুনিক যোগাযোগের প্রভাব:
বিশ্বায়নের যুগে উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থার ফলে জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বেড়েছে। আন্তঃগোষ্ঠীগত বিবাহ ও সামাজিক মেলামেশার কারণে “বিশুদ্ধ রক্ত” সংরক্ষণ আর সম্ভব নয়।
৪. বাংলাদেশ ও বাঙালির উদাহরণ:
বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীও একটি সংকর জাতি। স্যার হারবার্ট রিসলি, বিদ্যাবিনোদ শঙ্কর, এবং সুন্দরলাল চন্দ্রসহ অনেক গবেষকই বলেছেন, বাঙালি জাতির গঠনে দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়, আর্য, আরব, তুর্কি, আফগান ও পারস্যি জাতির রক্ত মিশে আছে। বাঙালিদের চোখ, চুল, গায়ের রং, নাকের গঠন এসব বৈশিষ্ট্যে এই মিশ্রণের ছাপ স্পষ্ট।
৫. শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা:
দুইজন মানুষের দেহে হুবহু মিল পাওয়া সম্ভব নয় এমনকি আঙুলের ছাপ পর্যন্ত আলাদা। তাই যদি একই পরিবারের সদস্যদের মাঝেও শারীরিক বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য থাকে, তাহলে পুরো একটি গোষ্ঠী খাঁটি বলে ধরে নেওয়া অযৌক্তিক।
৬. নৃবিজ্ঞানীদের ভাষ্য:
নৃবিজ্ঞানীরা মানুষের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করে বলেছেন, মানুষ যখন প্রথম পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়, তখন থেকেই বিভিন্ন জলবায়ু ও পরিবেশের প্রভাবে শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। আবার এই পরিবর্তন শুধু একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা এক গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়েছে।
৭. বর্ণবাদ ও বিশুদ্ধতা বিভ্রান্তি: কিছু বর্ণবাদী নৃবিজ্ঞানী অতীতে দাবি করতেন, “বিশুদ্ধ” শ্বেতকায় জাতির সঙ্গে অশ্বেতকায় জাতির সংমিশ্রণ হলে সভ্যতা নষ্ট হয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান তা প্রত্যাখ্যান করেছে। মানবিক মর্যাদা, বুদ্ধিমত্তা কিংবা সভ্যতা কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর একক সম্পত্তি নয়।
উপসংহার: সবশেষে বলা যায়, “বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠী” আসলে কেবল একটি কল্পনামাত্র। ইতিহাস, বিজ্ঞান এবং বর্তমান বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, মানবজাতি বরাবরই একটি সংকর জাতি। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ পরস্পরের সংস্পর্শে এসে একটি বৈচিত্র্যময় মানবসমাজ গঠন করেছে। তাই আজকের পৃথিবীতে কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে “বিশুদ্ধ” বলে দাবি করা যেমন ভুল, তেমনি এই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়া বৈজ্ঞানিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনুচিত।
সুতরাং, “বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠী একটি অলীক কল্পনা” উক্তিটি বাস্তব ও যুক্তিসম্মত।

No comments:
Post a Comment